করোনার সংক্রমণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বাভাবিকভাবেই হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। ক্রমবর্ধমান রপ্তানি আয় কমে গেছে। কমেছে প্রয়োজনীয় পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। তবে সংকটের বাজারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুুযোগ এসেছে। বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন। আবার চীন থেকে বিভিন্ন দেশের বড় কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। এতে চীনের বাজারে পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ এসেছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে খুব শিগগির স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে দেশ। এতে বিশ^ বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, কৌশল ও কৌশলপত্র তৈরি করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাণিজ্যিক সুবিধা নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশে^ করোনার সংক্রমণের শুরু গত বছরের শেষ দিকে। চলতি বছরের শুরু থেকে তা প্রকট আকার নিয়েছে। করোনার সংক্রমণে স্বাস্থ্যের পাশাপাশি অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে। তাতে ১৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে।
চলতি বছর বৈশ্বিক রপ্তানি ২ লাখ ৪৭ হাজার কোটি ডলার থেকে ৬ লাখ কোটি ডলার পর্যন্ত কমতে পারে। পর্যটন খাতের ব্যবসা কমবে ৫৮ থেকে ৭৮ শতাংশ। আর করোনায় গত জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৯০০ থেকে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার ক্ষতি করেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ সাড়ে ৭৬ হাজার কোটি থেকে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কোভিড পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা কমে যাবে। ফলে আমাদের রপ্তানি খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে।
ভয়াবহ এই সংকটের মধ্যে গত মাসে শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করে চীন। চীনের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী, দেশটিতে ৮ হাজার ২৫৬ পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা মিলবে। তার আগ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় থাকা ৫ হাজার ১৬১ পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যটিই ছিল না। তবে সম্প্রতি চীনের শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধায় যুক্ত হওয়া নতুন ৩ হাজার ৯৫ পণ্য যুক্ত হয়েছে। এই সুবিধা দেখিয়ে সহজেই চীন, ভারতসহ অন্য দেশের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব। কারণ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির বাজার পণ্য উৎপাদকদের জন্য লোভনীয়। তা ছাড়া শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগিয়ে চীনের আমদানি বাণিজ্যের মাত্র ১ শতাংশ হিস্যা দখল করতে পারলে দেশটিতে ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় বাড়ানো সম্ভব। বর্তমানে চীন বছরে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, সেখানে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র দশমিক ০৫ শতাংশ। তবে কী কী পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফলে সুবিধাটি কতটা কাজে লাগানো যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তবে চীনের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা এককেন্দ্রিক। মোট আমদানির প্রায় ২৮ ভাগ করা হয় চীন থেকে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ দশমিক ০৫ শতাংশ। অবশ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের তালিকায় প্রধান পণ্যগুলো না থাকলেও বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে চীনে রপ্তানি আয় বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগ হতে পারে বড় হাতিয়ার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, তৈরি পোশাকে চীনের বাজার হিস্যার ১৯ শতাংশ ভিয়েতনামের দখলে। আর বাংলাদেশের হিস্যা ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। চামড়ায়ও ভিয়েতনামের চেয়ে বেশি পিছিয়ে বাংলাদেশ। চীনে পোশাক ও চামড়া রপ্তানিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম কেউই শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না।
করোনার সংকট শুরুর আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এ যুদ্ধের ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে বিভিন্ন দেশের বড় বড় কোম্পানি চীন থেকে সরে আসছে। জাপান তাদের সব বিনিয়োগ ও রপ্তানি আদেশ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভারত নতুন করে বিনিয়োগের চিন্তা থেকে সরে এসেছে। চীনের বিকল্প বিনিয়োগ ক্ষেত্র হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। ব্যবসা সহজ করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় অনেক পিছিয়ে। জাপান ও ভারতের বিনিয়োগকারীরা চীনের বাজার ধরতে বিকল্প স্থান খুঁজতে পারে। সেক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ অন্যতম ক্ষেত্র। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ভিয়েতনাম যতটা এগিয়ে ততটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রপ্তানিতে ভালো করতে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ ছাড়া বিকল্প নেই। এজন্য আসিয়ানের পর্যবেক্ষক দেশ হওয়ার উদ্যোগ দরকার। তা ছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনার বিষয়ে আমরা অনেক কথা বলছি। অথচ বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতকে সংযুক্ত করার নীতিই নেই। তিনি বলেন, চীন থেকে স্থানান্তরিত বিনিয়োগ টানতে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। বন্দর থেকে মাল খালাসের ধীরগতির কারণে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আমরা প্রতিনিয়তই বৈশি^ক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাচ্ছি। লজিস্টিক ও অবকাঠামোর দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে আমাদের সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান দরকার।
বিনিয়োগের আকৃষ্ট করতে পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে স্বীকার করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, স্থানান্তরিত বিনিয়োগ টানতে অন্য দেশ যেসব সুবিধা দিচ্ছে, বাংলাদেশকেও সে ধরনের সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। তাড়াতাড়ি কাজটি শেষ করতে চাই, যাতে ট্রেন মিস না হয়।
এদিকে বাংলাদেশ আগামী ২০২১ সালে জাতিসংঘের মূল্যায়নে এলডিসি তালিকা বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। মূল্যায়নে যোগ্য হলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে। এই তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে গেলে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না। আবার দেশের রপ্তানি খাতকে এগিয়ে নিতে যে ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকেও তা দিতে পারবে না। রপ্তানিতে নগদ সহায়তা, ভর্তুকি, কর রেয়াত, আমদানি পণ্যে শুল্কারোপ এসব করতে পারবে না। ফলে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বাংলাদেশ।
ইউরোপের বাজারে যেতে হলে গড়ে ১২ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন এমনকি ভারতের বাজারে যেতেও হলে অনেক বেশি শুল্ক দিতে হবে। এর থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করা। বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে পারেনি। শুধু এ বছরের মধ্যে ভুটানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও ভুটানের সঙ্গে চুক্তি করে রপ্তানি বাণিজ্য প্রসারিত করার সুযোগ কম। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তির দ্বারপ্রান্তে।
চীনের সঙ্গে দেশটির চুক্তি রয়েছে। এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে ঢুকতে হবে। বর্তমান শুল্ক শূন্য শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমানে ভিয়েতনাম প্রায় ১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ইউরোপে পণ্য রপ্তানি করে। ২০২৪ সাল থেকে ভিয়েনামের শুল্ক হবে শূন্য শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে অসম যুদ্ধে নামতে হবে বাংলাদেশকে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে মেধাস্বত্ব আইন বা পেটেন্ট নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওষুধ শিল্প। এখন বিনামূল্যে ওষুধের ফর্মুলা ব্যবহার করে ওষুধ উৎপাদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু উত্তরণের পর এটি আবিষ্কারক দেশের কাছ থেকে কিনতে হবে। নতুবা আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ হতে বাংলাদেশের উত্তরণ হলে আমাদের পণ্যের ওপর ১২ শতাংশ শুল্কারোপ করা হবে, যেখানে ভিয়েতনাম শূন্য শুল্ক সুবিধা নিয়ে পণ্য রপ্তানি করবে, এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। তিনি বলেন, শিল্পায়ন কৌশল এবং বাণিজ্য কৌশলের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে, যা আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্ষমতা বাড়াবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক ট্রিটি’ স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
Leave a Reply